সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:০২ অপরাহ্ন
অভ্যুত্থান পরবর্তী শ্রীলঙ্কার পথে বাংলাদেশের রাজনীতিকে হাঁটতে দেয়া যাবে না – এনামূল হক পলাশ
একনায়ক শাসক গোটাবায়া রাজাপাকসের শাসনামলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, জরুরি ওষুধ, খাদ্যসামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র অভাব, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থা, সবকিছু মিলিয়ে শ্রীলঙ্কার জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলে সব সূচকেই শ্রীলঙ্কা অস্বাভাবিক অবস্থানে বা তলানিতে নেমে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যায়। আপাত বিক্ষোভের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে ২০২২ সালের ৯ জুলাই। কয়েক মাস ধরে চলা এই বিক্ষোভকে সিংহলী ভাষায় বলা হয় ‘আরাগালয়’। যার অর্থ সংগ্রাম। এদিন বিক্ষোভকারীরা সেখানকার প্রেসিডেন্ট ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন দখল করে নেয়। তাদের উল্লাস ও তাণ্ডব ধ্বংসাত্মক রূপ নেয়। কিছু সময়ের জন্য ওই দুটি ভবন ও চত্বর যেন গণসম্পত্তি ও দর্শনীয় পার্কে পরিণত হয়। বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি ও ব্যক্তিগত বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে পেছনের দরজা দিয়ে পলায়ন করেন। বিমানবন্দর ও নৌবাহিনীর জাহাজে পালাতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে সেনাবাহিনীর বিমানে করে মালদ্বীপ পৌঁছেন। এরপর সিঙ্গাপুর।
শ্রীলঙ্কায় এই বিক্ষোভের সূচনা হয় ২০২১ সালের এপ্রিলে যখন জৈবসার আমদানি ও ব্যবহার বন্ধ করে সরকার শুধু অরগানিক সার ব্যবহার করতে নির্দেশ দেয় তখন সেখানকার কৃষকরা বিক্ষোভ শুরু করে। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল আমদানিতে অর্থ সাশ্রয়। কিন্তু তাতে কৃষি উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পেয়ে কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে যায় এবং দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। যদিও পরে এই নির্দেশ বাতিল করা হয়, ততদিনে যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। করোনার ছোবল ও ইউক্রেন যুদ্ধে দ্বিতীয় আঘাত আসে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাতে। বৈদেশিক রেমিট্যান্সও কমে যায়। শুরু হয় শ্রীলঙ্কার অর্থ মন্দা, বৈদেশিক রিজার্ভের অস্বাভাবিক হ্রাস, খাদ্য ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, জরুরি ওষুধ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীর তীব্র অভাব, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট, যার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা বন্ধ রাখতে হয়। আমদানি করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলায় দেশটির জনজীবনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। মার্চ ২০২২ থেকে শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন। অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে আন্দোলন শুরু হলেও পরে এটি রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয়। জনরোষ গিয়ে ঠেকে দুই দশক ধরে কর্তৃত্ববাদী শাসক গোষ্ঠী রাজাপাকসে পরিবারের ওপর। তাদের একনায়কত্ব, দুর্নীতি, গুম, স্বজনপ্রীতি ও দুঃশাসনের জন্য এসব হয়েছে বলে জনগণ অভিযোগ করতে থাকে। একই পরিবারের অন্তত সাতজন সরকারের দায়িত্বে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ্রা, ছেলে যোশিথ, ভাই বাসিল ও চমল এবং চমলের ছেলে নমল ও সশীন্দ্র যারা সবাই রাজাপাকসে পরিবারের সদস্য। তারা সবাই মন্ত্রিত্বসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। অথচ এই গোটাবায়াই তিন দশকের তামিল টাইগারদের বিদ্রোহ নিষ্ঠুরভাবে দমন করে হিরো বনে গিয়ে ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
বাংলাদেশেও এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশে অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, গুম, বিচারহীনতাসহ নানামাত্রিক ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপ চলছিল। এ কারণে মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বাড়তে থাকে। তারই বহিঃপ্রকাশের ফল উপমহাদেশের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ঘটানো একনায়ক শেখ হাসিনার পতন। এই পতনে কান্ডারির ভূমিকা পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজ। তাদের সাথে যোগ দেন দেশের সাধারণ মানুষ। এই আন্দোলন প্রথমে কোটা বিরোধী আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরবর্তীতে এটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। ফ্যাসিস্ট রেজিমের হত্যার শিকার হয় শিশু-কিশোর, নারী, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ১৫ শ’ থেকে ২ হাজারের বেশি মানুষ। এবং চোখ, মুখ, হাত-পা হারিয়ে আহত হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ।
এই গণ-অভ্যুত্থান ঘটাতে গিয়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করে। ফলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার ও তার দোসররা পালাতে বাধ্য হন। শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন।
রাজাপাকসের ‘ক্যাডার’রা বিভিন্ন স্তরে রয়ে যাওয়ার কারণে তারা প্রতিমুহূর্তে আন্দোলনকে সাংস্কৃতিকভাবে স্যাবোটাজ করেছে। সেখানেও একদল তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল প্রচার প্রপাগাণ্ডা করে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনকে ব্যহত করেছে। ফলে শ্রীলঙ্কায় গণ-বিক্ষোভের মুখে রাজাপাকসে সরকারের পতনের পর অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে রাজাপাকসের উত্তরসূরী হওয়া স্বত্বেও স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় অবস্থানে গেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। যদিও দেশটির বামপন্থী ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) অ্যালায়েন্সের প্রার্থী ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে অনুরা কুমারা দিসানায়ে জয়ী হয়েছেন এবং দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন বর্তমান বিরোধী দলের নেতা সজিথ প্রেমাদাসা।
একই ঘটনা আমরা বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করতে পারছি। হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের ‘ক্যাডার’রা বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। তারা প্রতিমুহূর্তে নয়া বাংলাদেশকে সাংস্কৃতিকভাবে স্যাবোটাজ করছে। এখানেও একদল তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল প্রচার প্রপাগাণ্ডা করে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনকে ব্যহত করেছে। তারা তাদের সেই পুরনো বয়ানকে সামনে এনে পরিবর্তনকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার অভূতপূর্ব গণঅভুত্থানের ফলে স্বৈরশাসক পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। একসাথে একটি দেশের গোটা পার্লামেন্টের পলায়ন ইতিপূর্বে বিশ্বে আর ঘটে নি। এই ঘটনায় শাসক থেকে শুরু করে জাতীয় মসজিদের ইমাম পর্যন্ত পলায়ন করেন। কিন্তু যে সকল দানবীয় শক্তি এই সিস্টেমকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে তারা মূলত অপসারিত হয় নি। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সরকারের ভেতর থাকা দানব বানানোর সিস্টেমকে বিদায় জানানোর সময় এসেছে। এই সংঘবদ্ধ পরজীবিরা অতীতের যে কোন সরকারকে বিতর্কিত করেছে, এমনকি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠার পেছনে দায়ী। এরা আগামী সরকারকে বিতর্কিত করবে। এসব অবসান ঘটানোর সময় এসেছে। প্রত্যেকটি জনপ্রতিষ্ঠানে ও সচিবালয়ে যারা স্বৈরশাসকের অপশাসনকে সায় দিয়ে, গণহত্যাকে সমর্থন দিয়ে এবং সরকারের পক্ষে দালালি করে জনমানুষের উপর জুলুম নিপীড়ন নির্যাতন ও দুর্ভোগকে প্রলম্বিত করেছে সেইসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীকে অবিলম্বে অপসারণ করা সময়ের দাবি। এইসব দালালরা পদচ্যুত না হওয়ায় এখনো বিভিন্ন ভাবে জনমানুষকে হয়রানি করছে এবং নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে ক্রিয়াশীল। তাদের রোষানলের শিকার হচ্ছেন গণঅভুত্থানের অগণিত সমর্থনকারী।
প্রচার প্রপাগান্ডার জন্য তারা সাথে নিয়েছে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম, প্রবাসী পেইড বুদ্ধিজীবী, দেশের অভ্যন্তরে থাকা সুশীল নামধারী কিছু কর্তৃত্ববাদের সুবিধাভোগী দোসরকে। এদেরকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি জনপ্রতিষ্ঠানে লুকিয়ে থাকা ফ্যাসিবাদের দালাল। ছোট বড় কিছু রাজনৈতিক দলের কিছু সংখ্যক নেতা যারা পুরনো ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চায় তারাও এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। তারা ইতিমধ্যে বয়ান তৈরি করা শুরু করে দিয়েছে।
বেশিরভাগ ভারতীয় গণমাধ্যম ও তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়ালরা বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানকে বিরোধী দল, ইসলামী জঙ্গি এবং পশ্চিমা শক্তির ষড়যন্ত্র হিসেবে মিথ্যাভাবে চিত্রিত করছে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর কিছু ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেগুলো মূলত ছাত্র বিক্ষোভকারীদের নেতৃত্বে ঘটেনি, বরং জনতা দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, ছাত্র নেতারা বারবার সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়ালরা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বয়ান দিতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বৃদ্ধির কথা প্রচার করছে। দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে, অর্ণব গোস্বামী, রুবি লিয়াকোট এবং রজত শর্মার মতো ভারতীয় সাংবাদিকরা আন্দোলনকারীদের উগ্র ইসলামপন্থী এবং গুন্ডা হিসেবে ভুলভাবে চিহ্নিত করেছেন, যার ফলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে।
আমরা যদি এই বয়ানগুলোর কাউন্টার বয়ান তৈরি করতে না পারি, তাহলে হাসিনার বা তার দোসরদের ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ফিরে আসা অসম্ভব নয়। এমনও হতে পারে আওয়ামী লীগ নিজ নামে ফেরত না এসে আমাদের পরিচিত বন্ধু ফ্যাসিবিরোধী কোন দলের রন্ধ্রে ঢুকে আবারও বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদ কায়েম করবে। আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনী বৈতরণীর আশায় দিন গুণছে। প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থায় আওয়ামী কর্তৃত্ববাদ ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে। এই বিষয়গুলো প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের সাংস্কৃতিক লড়াই চালাতে হবে। একমাত্র সাংস্কৃতিক বিপ্লবই পারে আগামী দিনের ফ্যাসিবাদী চিন্তা এবং কর্তৃত্ববাদ ঠেকিয়ে দিতে।
লেখক : কবি ও ভাবুক।