বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১১ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক, নেত্রকোণার আলো ডটকম:
নেত্রকোণার আটপাড়া উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামের জোনাকি খানম । দুই বছর আগেও ছিলেন গৃহিনী। তারও দুই বছর আগে; করোনা বিপর্যয়ের মধ্যে ২০২১ সালের শুরুর দিকে স্বপ্ন বুণন করা শুরু করেন। এর পর থেকে সংগ্রামী পথচলায় ধীরে ধীরে নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে থাকেন। এভাবেই এগিয়ে চলায় নিজের পাশাপাশি সহযাত্রী করেছেন আরো আনেক গৃহিনী, তরুণী ছাড়াও যুবকদের। প্রান্তিক এক গ্রাম থেকে উঠে আসা স্বপ্নবাজ জোনাকি খানম এখন পিছিয়ে থাকা নারীদের আইডলে পরিণত হয়েছেন।
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন স্বামী মো: রেজাউল ইসলাম। ২০১৮ সালে বিয়ের পর থেকে ঢাকার বাসাতে ঘর সামলিয়ে আসছিলেন জোনাকি খানম। এক পর্যায়ে স্বামীর উৎসাহ আর নিজের একাগ্রতায় গৃহিনী থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে মেলে ধরার ব্রত নিয়ে জীবন যুদ্ধে নামেন জোনাকি। ২০২১ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি ডিজিটাল মার্কেটিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন। দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষে ২০২৩ সালে তিনি সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
বর্তমানে জোনাকি যুক্তরাজ্য ও ইতালির নামকরা দুই প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল মার্কেটার হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি, দেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্যও তাঁর দক্ষতা কাজে লাগছে।
তিনি ইতিমধ্যেই “আপটার্ন আইডিয়া”নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেখানে ১০ জন তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হয়েছে।
জোনাকীর প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, সরকারি তীতুমীর কলেজের ছাত্রী সাবিয়া ইসলাম সুমি।
সুমি বলেন, “জোনাকীর প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আমি হাতে খরচের পাশাপাশি বাড়তি অর্থ উপার্জন করছি এবং কাজও শিখছি।”
ঢাকা টি এন্ড টি কলেজে স্যোশাল ওয়ার্ক বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া সুলতানা বলেন, “আমি জোনাকি আপুর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মিডিয়া বায়িংয়ের ওপর ব্যাচ পরে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন আপুর এইখানেই আপটার্ন আইডিয়াতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করছি। এখানে যোগ দেয়ার পর থেকে এখন নাগাদ আমি মুটামুটি নিজের খরচ চালাতে পারছি। নিজের কিছু কিছু শখ যেটা আগে পারতাম না এখন পূরণ করতে পারছি। ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করতে পারবো বলে আশা করছি। “
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী তানজিয়া পাঠান তাশি বলেন, “আমি জোনাকি খানমের সাথে অনেক দিন যাবৎ কাজ করছি গ্রাফিক্স এবং সোস্যাল মিডিয়া বায়িং নিয়ে। আমি নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি নিজের অনেক শখ পূরণ করার সাহস পাচ্ছি।
জোনাকি বলেন, “আমি সমাজের পিছিয়ে পড়া তরুণ-তরুণীদের দক্ষ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। ফ্রিল্যান্সিং নারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা নিয়ে এসেছে। এটি তাদেরকে পরিবারের দায়িত্ব পালনে এবং আর্থিক অবদান রাখতে সাহায্য করছে।”
ঢাকার তেজগাঁও কলেজ থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক জোনাকীর স্বপ্ন, তার প্রতিষ্ঠান এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে এবং আরো তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
সমাজে নারীদের অবদান ও গৃহিণীদের কাজের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “গৃহিণী টু উদ্যোক্তা” নামে একটি উদ্দীপনামূলক প্রকল্প চালু করেছেন নেত্রকোণার প্রত্যন্ত গ্রামের এক সময়ের তরুণী জোনাকি ।
গত দুই বছরে তিনি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন এবং এখন তার উদ্যোগে ৩০ জন নারী ও পুরুষকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
জোনাকি জানান, তার পেইজে প্রায় ৩৫,০০০ থেকে ৪০,০০০ গৃহিনী যুক্ত হয়েছেন। ইনবক্সে তাদের সমস্যার কথা জানাতে এসে প্রায় সবাই বলেছেন, “কিছু করি না, আমি গৃহিণী।” এই ধরনের ধারনা পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে জোনাকি তাদেরকে দক্ষ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করছেন।
তিনি বলেন, “আমাদের সমাজ গৃহিণীদের কাজকে কখনো স্বীকৃতি দেয় না। একজন গৃহিণী সপ্তাহে কর্মজীবী মানুষের তুলনায় ৩৮ ঘণ্টা বেশি কাজ করেন, তবুও নিজেকে বেকার মনে করেন।”
জোনাকী আরও বলেন, “আমার লক্ষ্য সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া গৃহিণী এবং পুরুষদের ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে তারা নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।”
বর্তমানে তিনি দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য ডিজিটাল মার্কেটার হিসেবে কাজ করছেন। মাসে এক লাখ টাকারও বেশি আয় করছেন। আগামী মাসের শুরুতে আরও ৩০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার।
জোনাকি খানমের এই উদ্যোগ দেশের নারীদের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে এবং সমাজের মধ্যে গৃহিণীদের কাজের মূল্যায়ন করতে সাহায্য করছে।
স্ত্রীর গড়ে তোলা আপটার্ন আইডিয়াতে প্রধান ভিডিও সম্পাদনার কাজ করা জোনাকির স্বামী মো: রেজাউল ইসলাম বলেন, “শুরুতে জোনাকিকে উৎসাহ দেই এগিয়ে যেতে। আজকের এই প্রতিষ্ঠার পথচলায় সব সময়েই পাশে রয়েছি। এখন জোনিাকি তার দক্ষতা দিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে। তার হাত ধরেই অনেক নারী আত্মনির্ভরতার মধ্য দিয়ে মর্যাদা লাভ করছে। আমি তার জন্যে গর্বিত।”